November 21, 2024, 12:32 pm

ঈদ শেষে অনেকেই ফিরছেন নৌপথে; লোকসান কাটিয়ে লাভের ঘরে লঞ্চ মালিকরা

ঈদ শেষে অনেকেই ফিরছেন নৌপথে; লোকসান কাটিয়ে লাভের ঘরে লঞ্চ মালিকরা

ঈদের ছুটি শেষে রাজধানীমুখী বাসে টিকেট সংকটের কারনে শুক্রবার বরিশাল নদী বন্দরেও যাত্রীদের উপচে পড়া ভীর ছিলো চোখে পড়ার মতো। ছবি- বিপ্লবী বাংলাদেশ।

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ঈদের আগে পরিবার নিয়ে পদ্মা সেতু হয়ে সড়কপথে বরিশালে এসেছিলেন মকসুদ চৌধুরী। স্বপ্নের সেতু দেখার অদম্য ইচ্ছা থেকেই ওই পথে আসা। ঈদ উদ্যাপন শেষে অবশ্য আর সড়কপথে যাননি। লঞ্চে ফেরেন ঢাকার কর্মস্থলে। মকসুদ বলেন, ‘স্বপ্নের সেতু হয়ে মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টায় বরিশালে পৌঁছেছি এটা ঠিক।

তবে আমরা যারা ভাটি অঞ্চলের বাসিন্দা তারা বাসে সোজা হয়ে বসে থাকা কিংবা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকার মতো পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত নই। লঞ্চে হাত-পা দুলিয়ে, হেঁটে-চলে, নরম বিছানায় ঘুমিয়ে যাতায়াত আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। তাছাড়া স্ত্রী-সন্তানরাও বাসের পরিবেশে খুব একটা কমফোর্ট ফিল করে না।

যে কারণে সবাইকে নিয়ে লঞ্চেই ফিরছি। তবে এটা ঠিক যে, এখন থেকে জরুরি যাতায়াতের দরকার পড়লে পদ্মা সেতু পার হয়েই যাওয়া-আসা করা হবে। বুধবার রাতে যখন কথা হচ্ছিল মকসুদ চৌধুরীর সঙ্গে তখন বরিশাল ঘাট থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য যাত্রী তুলছিল ৮টি লঞ্চ। প্রচুর যাত্রীও ছিল ঘাটে। সবাই ঈদ শেষে ফিরছেন ঢাকায়।

সরকারি চাকুরে ডা. সাঈদ আবিদ বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের জন্য বিশাল এক প্রাপ্তি এটা যেমন ঠিক তেমনি জার্নি বলতে লঞ্চে যে কমফোর্ট সেটাই বা কোথায় পাব? রাতে ডেকে বসে নদীর বুকে চাঁদের আলো দেখা, অনেকে একসঙ্গে গোল হয়ে আড্ডা দেওয়া, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনের শুভ্র সফেদ বিছানায় শান্তির ঘুম আর ভোরে চোখ খুললেই ঢাকা।

এমন শান্তির যাত্রা তো শুধু লঞ্চেই সম্ভব। তাইতো আসার সময় পদ্মা সেতু দেখতে দেখতে সড়কপথে এসেছি আর যাচ্ছি লঞ্চে চেপে। গার্মেন্টকর্মী আঁখিনুর বেগম বলেন, ‘বাস টার্মিনাল গেছিলাম। ঢাকা যাইতে ভাড়া চায় একেকজন ৫শ টাহা। মুই, মোর স্বামী আর দুইডা মাইয়া পোলা, সব মিলাইয়া ২ হাজার টাহা লাগবে। লঞ্চে ভাড়া ৩৫০ টাহা।

মাইয়া পোলা দুইডার টিকিট না কাডলেও অইবে। হ্যাতে ৭শ টাহায় যাইতে পারমু। মোরা গরিব মানুষ। অত টাহা দিয়া বাসে যামু ক্যামনে?’ আঁখিনুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখ পড়ে ঘাটে থাকা লঞ্চগুলোর দিকে। প্রায় প্রতিটি লঞ্চের ডেকে বিপুলসংখ্যক যাত্রী। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শুধু ডেক নয়, ভিআইপি এবং সোফাসহ প্রথম শ্রেণির কেবিনগুলোও পরিপূর্ণ। সব লঞ্চেরই প্রথম শ্রেণির টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে বহু আগে। এরপরও লঞ্চগুলোতে উঠছিলেন যাত্রীরা।

বরিশাল নদীবন্দরের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শক কবির হোসেন বলেন, ‘ঈদের পরদিন ১১ জুলাই যাত্রীর চাপ কিছুটা কম থাকলেও পরের দিনগুলোতে মোটামুটি ভালো যাত্রী পাচ্ছে লঞ্চগুলো। বুধবার বরিশাল থেকে ছেড়ে গেছে ৮টি লঞ্চ। এরমধ্যে ৪টি ঢাকায় যাত্রী নামিয়ে আবার ফিরেছে বরিশালে স্পেশাল সার্ভিসের জন্য।

বৃহস্পতিবার বরিশাল থেকে ঢাকায় যেতে ঘাটে প্রস্তুত আছে ১১টি লঞ্চ। এরমধ্যে ৭টি নিয়মিত এবং ৪টি বাড়তি চাপ সামলাতে স্পেশাল সার্ভিসের জন্য।’ ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী এমভি মানামী লঞ্চের কর্মকর্তা রিপন খান বলেন, ‘১২ জুলাই থেকেই বাড়ছে যাত্রী চাপ। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, শুক্র ও শনিবার এই চাপ আরও বেশি হবে।

যতদূর জানি, রোববার পর্যন্ত ঢাকামুখী কোনো লঞ্চেরই কেবিন খালি নেই। তাছাড়া ডেক যাত্রীরও চাপ বাড়ছে।’ একজন লঞ্চ কর্মচারী বলেন, ‘বর্তমানে যেভাবে যাত্রী হচ্ছে তাতে মোটেই লোকসানে নেই লঞ্চ মালিকরা। মোটামুটি আকারের একটি লঞ্চ বরিশাল থেকে গিয়ে ঢাকা ঘুরে আসতে ৩৮ ব্যারেল তেল দরকার হয়।

১৬ হাজার ২শ টাকা ব্যারেল দরে এর দাম পড়ে ৬ লাখ ১৫ হাজার ৬শ টাকা। এরসঙ্গে ১৮ হাজার টাকার মবিল এবং আনুষঙ্গিক ২৬ হাজার ধরলে মোট খরচ দাঁড়ায় ৬ লাখ ৫৯ হাজার ৬শ টাকা। একপথে যদি লঞ্চের সব কেবিন পূর্ণ থাকে তাহলে আয় হয় ৩ লাখ। এরসঙ্গে ১ হাজার ডেক যাত্রী ধরলেও যোগ হয় আরও সাড়ে ৩ লাখ টাকা।

এটা ঠিক যে বর্তমানে ঢাকা থেকে যাত্রী খুব একটা আসছে না। তারপরও অর্ধেক কেবিন এবং ৫শ ডেক যাত্রী ধরলেও আয় দাঁড়ায় সোয়া ৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ সাকুল্যে সাড়ে ৯ লাখ টাকার কাছাকাছি। ফলে রাউন্ড ট্রিপে মালিকের পকেটে যায় প্রায় ৩ লাখ টাকা। লঞ্চের খরচ এবং লাভের এ হিসাব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী কীর্তনখোলা লঞ্চের মালিক মঞ্জুরুল আলম ফেরদৌস বলেন, ‘ঈদের আগে-পরে যে যাত্রীর চাপ তাতে এই হিসাব অস্বীকার করছি না।

তাছাড়া আমরা কখনোই বলিনি যে পদ্মা সেতুর কারণে আমাদের যাত্রী কমবে। নতুন বউ দেখতে যেমন গ্রামের সবাই দলবেঁধে আসে তেমনি পদ্মা সেতু দেখার জন্য বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এখন সড়কপথে ঢাকা-বরিশালে যাতায়াত করছে। হাজার হলেও এই সেতু ছিল আমাদের ভাগ্য বদলের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন যখন বাস্তব তখন তা দেখতে মানুষ ছুটবে সেটাই স্বাভাবিক। সে কারণে বর্তমানে লঞ্চে যাত্রী কিছুটা কম হচ্ছে।

যখন বউ দেখা হয়ে যাবে তখন আবার সবাই আগের অভ্যাসেই ফিরবে। কেননা অভ্যাস বদলে ফেলা সহজ নয়। বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আগাগোড়াই বলে এসেছি যে সাময়িক কিছু সমস্যা আর সেতু উদ্বোধনের আগের তুলনায় ১০ থেকে ১৫ ভাগ যাত্রী কমতে পারে লঞ্চে।

এছাড়া ঐতিহ্যবাহী এই লঞ্চ সার্ভিসে পদ্মা সেতুর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। ধীরে ধীরে সেটাই হচ্ছে। বরঞ্চ আগে লঞ্চগুলো ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলত আর এখন সেগুলো যাবে নিয়ম মেনে ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী বোঝাই করে। তাছাড়া প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির ফলে লঞ্চের ভাড়া কমার সম্ভাবনা যেমন আছে তেমনি যাত্রীসেবার মানও আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাবে। বলা যায় এভাবেও পদ্মা সেতু আমাদের জন্য সুফল বয়ে নিয়ে এসেছে।

এদিকে যাত্রী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো রুপে ফিরেছেন লঞ্চ মালিকরা। আবার শুরু হয়েছে সরকারি রেটে ভাড়া আদায়। ঢাকা থেকে না হলেও বরিশাল থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ডেকের ভাড়া নেয়া হচ্ছে মাথাপিছু ৩৫০ টাকা। কেবিনের ভাড়াও আদায় হচ্ছে সরকার নির্ধারিত ১৪শ এবং ২৬শ টাকা। অথচ পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রী সংকট দেখা দিলে অনেকাংশেই কমে গিয়েছিল এই ভাড়া। ডেকে ২৫০ টাকায় যাত্রী আনা-নেয়া করেছে লঞ্চগুলো।

কেবিনের ভাড়াও কমেছিল ৪শ থেকে ৬শ টাকা পর্যন্ত। বিষয়টি সম্পর্কে আলাপকালে কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি এবং সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘লঞ্চের ভাড়া তো কমানো হয়নি। আমরা অতিরিক্তও নিচ্ছি না। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও খানিকটা কম নেয়া হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে।’

ঈদের সপ্তাহখানেক আগে কম ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওটা কিছু কিছু লঞ্চ মালিকদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল। যাত্রী কম হওয়ায় ভাড়া কমিয়ে নিয়েছে তারা। এখন আবার যাত্রী বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি রেটে চলছে ভাড়া আদায়। এটা নিয়ে তো কোনো সমস্যা নেই। যদি কেউ সরকারি রেটের বেশি ভাড়া নেয় তবে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব আমরা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © All rights reserved © 2024 DailyBiplobiBangladesh.com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com