July 23, 2025, 11:42 am
যাদের কণ্ঠে- গলা মেলায় জনতার হৃদয়, যাদের গানে ঝরে পড়ে বঞ্চিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস- তাঁরা কখনো চলে যান না, তাঁদের শুধু সময়ের আরশিতে নতুন করে দেখা হয়। তেমনি এক মানুষ ছিলেন ফকির আলমগীর। আজ, তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে, স্মৃতির আকাশে ঝরে পড়ে এক শোকাতুর সংগীত, যে সংগীতে মিশে থাকে শ্রমিকের ঘাম, মেহনতি মানুষের মুখ, আর সংগ্রামী সময়ের পদচিহ্ন।
ফরিদপুর জেলার কালোমানুষের মাটি কলমরিধা গ্রামে ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। বাংলার ভাষা সংগ্রামের সেই গৌরবময় দিনে, যেন পূর্বনির্ধারিত ছিল তাঁর কণ্ঠ হবে বাঙালির আত্মার অনুবাদ। ছাত্রজীবনে জড়িয়ে পড়েন গণআন্দোলনের সংগীতচর্চায়। ষাটের দশকের উত্তাল দিনগুলোতে, এক হাতে বাঁশি, অন্য হাতে মাইক- জনতার মিছিলে তার পদযাত্রা হয়ে ওঠে ইতিহাসের অনুষঙ্গ। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান কিংবা ১৯৭১-এর রণক্ষেত্রে তাঁর গান ছিল অস্ত্র, ছিল অভয়, ছিল প্রেরণা। শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি গেয়ে গিয়েছেন “ও সখিনা”, “শান্তাহার”, “নেলসন ম্যান্ডেলা” কিংবা “জোন হেনরি”—যে গানগুলো কেবল সংগীত ছিল না, ছিল আন্দোলনের মন্ত্র।
গণসংগীত ছিল তাঁর অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোত। ১৯৭৬ সালে তিনি গড়ে তোলেন ‘ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী’—যেখানে সংগীত মানে ছিল না কেবল সুর বা ছন্দ, ছিল সমাজ বদলের আহ্বান। তাঁর বিশ্বাস ছিল—গান হবে প্রতিবাদ, গান হবে পথ দেখানো বাতিঘর। তিনি ছিলেন গানের যোদ্ধা, যিনি বিশ্বাস করতেন “সংগীতই পারে মানবতার মুক্তির কথা ছড়িয়ে দিতে”। সে লক্ষ্যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিচল থেকেছেন তিনি।
শুধু সংগীত নয়, সাহিত্যেও ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। ‘চেনা চীনা’ থেকে শুরু করে ‘স্মৃতির অ্যালবামে মুক্তিযুদ্ধ’—তাঁর কলম ছিল মানুষের কণ্ঠস্বরেরই আরেক রূপ। ‘আমার কথা’, ‘যারা আছেন হৃদয়পটে’, ‘গণসংগীতের অতীত ও বর্তমান’—এসব রচনায় ফুটে উঠেছে তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর সংগ্রামের ইতিহাস এবং বাঙালির আত্মপরিচয়ের মর্মবাণী। তাঁর লেখাগুলো পড়লে বোঝা যায় একজন শিল্পী কতটা গভীরভাবে সমাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, কতটা দায়বদ্ধ থাকেন মানুষের প্রতি।
১৯৯৯ সালে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়—এ যেন এক দেরিতে আসা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তবু ফকির আলমগীরের প্রকৃত সম্মান ছিল মানুষের ভালোবাসায়, হাজারো মিছিলে তার কণ্ঠে গলা মেলানো শ্রমিকদের কণ্ঠস্বরে। তাঁর গান মানে ছিল প্রতিবাদ, তাঁর কণ্ঠ মানে ছিল প্রতিরোধ, আর তাঁর হাসিমাখা মুখ মানে ছিল ভবিষ্যতের ভরসা।
২০২১ সালের জুলাই মাসের শেষভাগে, যখন দেশজুড়ে করোনা ছায়ার মতো নামছে, তখনও তিনি চুপ থাকেননি। আক্রান্ত অবস্থাতেও সামাজিক সচেতনতার বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু অদৃশ্য শত্রুর কাছে হার মানলেন অবশেষে। ২৩ জুলাই রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে থেমে যায় এক বিস্ময়কর কণ্ঠের গতি। বিদায়ের ক্ষণে কেঁদেছে তাঁর গানের সাথী, কেঁদেছে গোটা জাতি। কিন্তু সত্যিকারের শোক ধরা পড়েছে মেহনতি মানুষের চোখে, যারা তাঁকে হৃদয়ে ধারণ করে।
আজ তাঁর অনুপস্থিতিতে আমরা আরও বেশি করে উপলব্ধি করি—তিনি কেবল একজন শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন সময়ের সাক্ষ্য, ইতিহাসের গীতিকার। তাঁর গান আজও শহরের অলিতে-গলিতে বাজে, গ্রামীণ মঞ্চে অনুরণিত হয়, শ্রমিকের কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে সুর হয়ে।
আজ মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই কালজয়ী ব্যক্তিত্বকে। ফকির আলমগীর শুধু একটি দৃষ্টান্তই নন, বরং এক আন্দোলন, এক অনুপ্রেরণা, এক অমর চেতনার নাম। তিনি আজ নেই, কিন্তু তাঁর সুর, তাঁর দৃপ্ত উচ্চারণ আর তাঁর বিপ্লবী হাসি বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে চিরকাল।
লেখক: বাহাউদ্দিন গোলাপ, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
Leave a Reply