January 31, 2025, 10:54 pm
শুরু হলো মহান ভাষার মাস ‘ফেব্রুয়ারী’
কমল সেনগুপ্ত
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি। ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি। আজ ভাষা আন্দোলনের মাস শুরু। মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয় সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারের রক্তে। ২২ ফেব্রুয়ারি ‘এ খবর ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করতে যারা তাদের অমূল্য জীবন দান করেছেন তাদের স্মরণে বাংলার প্রতিটি নগর বন্দর গ্রামগঞ্জে গড়ে ওঠে স্মৃতির মিনার- শহীদ মিনার।
বরিশালে এই খবর আসে ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা থেকে আগত মানুষের মুখে। ঐদিন রাতে অশ্বিনী কুমার হল চত্বরে নির্মাণ করা হয় অস্থায়ী শহীদ মিনার। ভাষা সৈনিক আবুল হাসেম এই শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পন করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। কিন্তু রাতেই পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে। স্মৃতির মিনার ভাঙ্গলেও বরিশালবাসীর মনে গড়ে ওঠে অসংখ্য শহীদ মিনার। স্থায়ী শহীদ মিনার গড় ওঠে অনেক দেরীতে। বরিশালে বিএম কলেজেই ছিল শহীদদের একমাত্র স্মৃতি সৌধ। তবে অশ্বিনী কুমার হলের সামনে প্রতিবছর প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করতো। দিনের আলো ফুটবার আগেই শ্রদ্ধাঞ্জলিতে ভরে যেত শহীদ বেদী। এ অবস্থা চলতে থাকে ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি, বাংলা ১৩৭৯ সনের ১৮ পৌষ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বরিশাল আসেন। ওই দিন তিনি বরিশাল শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। গণপূর্ত বিভাগের এই জমিতে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য প্রায় আড়াই লাখ টাকা মঞ্জুর করেন। ১৯৭৪ সালের ৩১ মে বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তৎকালীন জেলা প্রশাসককে সভাপতি এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে সাধারণ সম্পাদক করে বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ কমিটি গঠন করা হয়। তখনও প্রধানমন্ত্রীর মঞ্জুরীকৃত টাকা না পাওয়ায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ৫২ হাজার ১১৫ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব-পরিবারে হত্যা করা হলে দেশের রাজনীতি উল্টো ধারায় চলতে থাকে। সেই সাথে বন্ধ হয়ে যায় বাংগালী জাতির চেতনা শহীদ মিনার নির্মানের উদ্যোগ। তবে বাংগালীর মন থেকে কেউ মুছতে পারেনি একুশের চেতনাকে। প্রতি বছর একুশের ভোরে বরিশালবাসী বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্থাপিত শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্থর স্তম্ভেই শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করতো। এই স্থানই হয়ে ওঠে বরিশালবাসীর স্মৃতির মিনার। এভাবে প্রায় একদশক অতিক্রান্ত হয়। ১৯৮৫ সালের শহীদ দিবস পালন উপলক্ষে জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রমাণ হয় ইতিহাস কখনো পিছনে চলে না। বীরের রক্ত স্রোত কখনও বৃথা যায় না। ওই সভায় সাংবাদিক-নাট্যকার মিন্টু বসু, সংস্কৃতিজন অধ্যাপক বদিউর রহমান এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদ সুধীর সেন বরিশালে পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার নির্মাণের প্রস্তাব দিলে তা সর্ব সম্মতভাবে গৃহীত হয়।
সভায় বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ সাইফুদ্দিনকে সভাপতি এবং বরিশাল কলেজের উপাধ্যক্ষ শিক্ষাবিদ মোঃ হোসেন আলীকে আহ্বায়ক, বদিউর রহমান, সাংবাদিক সুধীর সেন ও বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের প্রতিনিধি মোঃ শাহ নেওয়াজকে যুগ্ম আহ্বায়ক, রূপালী ব্যাংকের ডিজিএম আবদুল আউয়ালকে কোষাধ্যক্ষ করে ৫৭ সদস্য বিশিষ্ট্য কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে সদস্য ছিলেন অ্যাডঃ ইউসুফ হোসেন হুমাউন, এমএ গফুর, এসএম ইকবাল, নূরুল আলম ফরিদ, মিন্টু বসু, মহিউদ্দিন মানিক, প্রভাষক নোমান রশীদ, শেখ আবদুল মালেক, দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, মহিউদ্দিন আহম্মদ, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, অনুতোষ ঘোষ, ঠিকাদার মতিউর রহমান, মানবেন্দ্র বটব্যাল, এনায়েত হোসেন চৌধুরী প্রমুখ। পরের সভায় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি নির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। নির্বাহী পরিষদের সভাপতি জেলা প্রশাসক ও সাধারণ সম্পাদক এনায়েত হোসেন চৌধুরী।
পূর্ণাঙ্গ কমিটির সভায় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অনুরূপ বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং এ ব্যাপারে আহ্বায়ক হোসেন আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ মিজানুল হক শেলী ঢাকার শহীদ মিনারের আলোকে মূল নকশা প্রস্তুত করেন। পরে ঢাকার শহীদ মিনারের হ্রাসকৃত একটি নকশা প্রস্তুত করা হয়। বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন। সার্বিক সহযোগিতা করেন তরুণ ঠিকাদার লাভলু হাসান। কমিটি সদস্য এনায়েত হোসেন চৌধুরী, মিন্টু বসু, শাহনেওয়াজ, বদিউর রহমান নির্মান কাজের তদারকি করেন। শহীদ মিনার নির্মানের জন্য অমৃত লাল দে, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, অপসোনিন ফার্মা লিঃ, বিডিএস, সিমেন্ট ব্যবসায়ী সমিতি, বাস মালিক সমিতি, হাজী আদম আলী এন্ড সন্স, হিমাংশু দাশগুপ্ত নাথু, আকতার হোসেন খান প্রমুখ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি নগদ অর্থ ও নির্মাণ সামগ্রী প্রদান করেন। অবশেষে ১৯৮৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নির্মাণাধীন বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বরিশালবাসী প্রথম শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে। ওই বছরই ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করে। ঢাকার পরে বাংলাদেশে এটাই বৃহত্তম শহীদ মিনার। এখানে উন্নয়ন সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ এখনও বাকী। কবে তা কবে পূরণ হবে বরিশালবাসী তা জানে না।
Leave a Reply