October 22, 2024, 3:34 am

স্বেচ্ছাসেবক লীগের ‘শিক্ষা সম্পাদক’ ভিসি বদরুজ্জামান ভূইয়া!

স্বেচ্ছাসেবক লীগের ‘শিক্ষা সম্পাদক’ ভিসি বদরুজ্জামান ভূইয়া!

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষকদের মানসিক নির্যাতন, অভিযোগ নানা দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছচারিতার
মেহেদী হাসান ॥ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের সমর্থন করে বিবৃতি দেয়ায় শিক্ষকদের মানসিক নির্যাতন, নানা দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো: বদরুজ্জামান ভূইয়ার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময়ে নানা অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তে জানা গেছে, ভিসি মো: বদরুজ্জামান ভূইয়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের শিক্ষা বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির ৭২ নং সদস্য। গত ৩১ জুলাই ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের শিক্ষা বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটি ঘোষনা করা হয় এবং ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর ঘোষনা করা হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি। আর সেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েই বনে গেছেন তিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে। জানা গেছে, গত ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করে বিবৃতি দেয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫ শিক্ষক। পরদিন ৪ আগস্ট এক ভার্চুয়াল সভায় ববি উপাচার্য বদরুজ্জামান ভূঁইয়াসহ আওয়ামী লীগঘেঁষা কয়েকজন শিক্ষক এ বিবৃতির বিষয়ে কৈফিয়ত চান এবং হুমকি দেন বলে অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ভার্চুয়াল সভায় উপাচার্য সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মধ্যে সরকারবিরোধী কেউ আছেন কি না। এমনকি উপাচার্য ও তাঁর অনুসারী শিক্ষকেরা বিবৃতি দেওয়া শিক্ষকদের তালিকা গোয়েন্দা সংস্থা এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের হাতে তুলে দেন।
এছাড়াও নাম না প্রকাশ করার শর্তে একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেন, যাঁরা ছাত্রদের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাঁদের ৪ আগস্টের সভায় হুমকি-ধমকি দেন উপাচার্যের আস্থাভাজন আওয়ামী লীগঘেঁষা শিক্ষকেরা। সভায় একজন আ.লীগ ঘেঁষা শিক্ষক এ জন্য ক্ষমা চাওয়ার কথাও বলেন। শিক্ষক সমিতির এক নেতা জানতে চান, গুগল ফর্ম কে বানিয়েছেন। প্রক্টরিয়াল বডির একজন জানতে চান, কারা ছাত্রদের ইন্ধন দেন। পরদিন সরকারের পক্ষে মানববন্ধনে থাকতেও চাপ দেওয়া হয় শিক্ষকদের। বলা হয়, যাঁরা মানববন্ধনে না আসবেন, ধরে নেওয়া হবে, তাঁরা সরকারবিরোধী। সভায় উপাচার্য শিক্ষকদের রাজনৈতিক বিষয়ে জড়ানো আইনগতভাবে ঠিক কি না, তা খতিয়ে দেখতে বলেন। এ বিষয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক উন্মেষ রয় বলেন, ৪ আগস্টের সভায় কৈফিয়ত চাওয়ার পর স্বাক্ষর দেওয়া ৩৫ শিক্ষকের মধ্যে আতঙ্ক ও ভয় দেখা দেয়। এখন সরকার পরিবর্তনের পর তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
সূত্র মতে ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারার হিসেবে নিয়োগ পান ববির বর্তমান উপাচার্য ড. মো: বদরুজ্জামান ভূইয়া।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. ছাদেকুল আরেফিন অবসরে যান। এরপর উপাচার্যের (রুটিন দায়িত্ব) পান ট্রেজারার ড. মো: বদরুজ্জামান ভূইয়া।
পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যম ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বনে যান বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এক আদেশে চলতি বছরের ৪ মার্চ বদরুজ্জামান ভূঁইয়াকে নতুন উপাচার্য নিয়োগ প্রদান করেন রাষ্ট্রপতি। আর উপাচার্য হওয়ার পর প্রথম নিয়োগ কার্যক্রমেই অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় প্রশ্নের মুখে পড়েন তিনি।
তৎকালীন নিয়োগ বোর্ড ও প্রার্থী সূত্রে জানা গেছে, আস্থাভাজন একজন শিক্ষককে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দিতে পিএইচডিধারী দুই প্রার্থীকে ইন্টারভিউ কার্ড দেননি বলে অভিযোগ ওঠে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। সংক্ষুব্ধ প্রার্থী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. আবু সালেহ এ নিয়ে উপাচার্যকে উকিল নোটিশ প্রদান করেন।
ওই সময় নিয়োগ বোর্ড পুনরায় গঠনের দাবিতে উপাচার্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, দুদক চেয়ারম্যানসহ সব সিন্ডিকেট সদস্যের কাছে লিখিত আবেদনও দিয়েছেন তিনি।
সংক্ষুব্ধ প্রার্থীর আবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে ৪ জন আবেদনকারীর মধ্যে তিনি (আবু সালেহ) এবং ড. মাহবুবুর রহমানই পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তাঁদের দুজনকে ইন্টারভিউ কার্ড ইস্যু না করে অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে ৩ এপ্রিল নিয়োগ বোর্ড বসে। সেখানে নিয়ম ভঙ্গ করে কেবল অভ্যন্তরীণ দুজন প্রার্থীকে নিয়ে বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ববির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাসুম সিকদারসহ দুজনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। অথচ তাঁরা পিএইচডি ডিগ্রিধারী নন।
বিশ্ববিদ্যালয় আরো সূত্রে জানা গেছে, ববির ৩২টি পদে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় চলতি বছরের ৬ মার্চ এবং ২১ মার্চ ছিল আবেদনের শেষ দিন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে শুধু একটি বিভাগের ২টি পদে ৩ এপ্রিল নিয়োগ বোর্ড বসায়। এ জন্য এক দিনের সময় দিয়ে ১ এপ্রিল হোয়াটসঅ্যাপে ইন্টারভিউ কার্ড পাঠায়। এছাড়াও তিনি জাতীয় একাধিক গণমাধ্যমে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুসকে নিয়ে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর “ড. ইউনূসকে নিয়ে বিদেশি বিবৃতি কীসের ইঙ্গিত” শীর্ষক কলাম বাংলাদেশ বুলেটিন নামক একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ করেন, এছাড়া দৈনিক নয়া শতাব্দী পত্রিকায় চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারী বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে কেউ নেই ও বিএনপির বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিশ্বাস না করা শিরোনামে আরো দুইটি কলাম লেখেন। এরকম একাধিক কলামের কপি এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
১৯৭৩ সালের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিত অন্য কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত থাকার সুযোগ না থাকলেও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ক্ষেত্রে হয়েছে পুরোই ব্যাতিক্রম।
তবে সচেতন মহল মনে করছেন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে তিনি যেভাবে কলাম লিখতেন বা বক্তব্য দিতেন তা কখনই কাম্য নয়।
এসকল অভিযোগের প্রেক্ষিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো: বদরুজ্জামান ভূইয়ার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
বিশ্বত্ব একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে উপাচার্য ড. মো: বদরুজ্জামান ভূইয়া গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই তাকে আর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখা যায়নি।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © All rights reserved © 2024 DailyBiplobiBangladesh.com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com