July 27, 2025, 2:18 pm
বাহাউদ্দিন গোলাপ
বাঙালি নারীকে ঘিরে প্রচলিত এক চিরায়ত চিত্র আছে- যেন তিনি কেবলই সংসারের প্রতিচ্ছবি, হাস্যোজ্জ্বল কোমলতা আর নিঃশব্দে সহ্য করার এক বয়নরেখা। কিন্তু ইতিহাসের কিছু মুহুর্ত এই চিত্রটিকে চূর্ণ করে, দাঁড় করিয়ে দেয় নারীকে দ্রোহের মূর্ত রূপে। সেই ব্যতিক্রমী ইতিহাসেরই এক দীপ্ত চরিত্র কমরেড কল্পনা দত্ত। একটি নাম, একটি সত্তা- যাঁর মুখোমুখি হলে আজও আমরা বিস্ময়ে থেমে যাই। সেই নারী, যিনি অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন স্বাধীন দেশের স্বপ্ন, রক্তে বইতে দিয়েছিলেন বিপ্লবের স্পন্দন।
১৯১৩ সালের ২৭ জুলাই, চট্টগ্রামের শ্রীপুর গ্রামে জন্ম নেন এই সাহসিনী। পরিবারটি ছিল শিক্ষিত, রাজনৈতিকভাবে সচেতন। বাবা ছিলেন বেঙ্গল অ্যাসেম্বলি অফিসের কর্মচারী। শৈশব থেকেই কল্পনা ছিলেন মেধাবী ও চিন্তাশীল। মাত্র বারো বছর বয়সেই তাঁর মনে দোলা দেয় বিপ্লবের বীজ- যখন তিনি পড়েন ক্ষুদিরাম ও কানাইলাল দত্তের আত্মত্যাগের কথা। সেই ক্ষুদ্র বয়সেই তিনি বুঝে যান, স্বাধীনতা বিনা মূল্যে আসে না- তা অর্জন করতে হয় রক্ত, ত্যাগ আর সাহস দিয়ে।
১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ভর্তি হন কলকাতার বেথুন কলেজে। কলকাতার বাতাস তখন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উত্তাল। কল্পনা সেই উদ্দীপনার মধ্যে নিজের অবস্থান খুঁজে নেন বিপ্লবী চেতনায়। তিনি যোগ দেন ‘ছাত্রী সংঘ’-এ, যেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের। দস্তিদারের হাত ধরেই তাঁর পথ গিয়ে মেলে মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী সংগঠনে। এই এক সিদ্ধান্তই বদলে দেয় তাঁর সমগ্র জীবন। তিনি তখন আর কল্পনা নন- তিনি তখন সময়ের দাবিতে হয়ে ওঠেন বাস্তবের অগ্নিকন্যা।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গুদাম দখল করে নেওয়া হয়, ঘোষণা করা হয় ‘স্বাধীন চট্টগ্রাম’। এ ছিল এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ, যা কাঁপিয়ে দেয় ব্রিটিশ প্রশাসনকে। ঘটনার পর কল্পনা ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। বিপ্লবীদের অনেকেই তখন গ্রেফতার হয়েছেন- অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বলসহ অনেকে তখন কারাগারে। এই সময়ে কল্পনার ওপর পড়ে বিশেষ দায়িত্ব। তাঁকে কলকাতা থেকে গোপনে গান-কটনসহ বিস্ফোরক সামগ্রী এনে চট্টগ্রামে সরবরাহ করতে হয়। শুধু তাই নয়, আদালত ও জেলখানায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বন্দী বিপ্লবীদের মুক্ত করারও একটি পরিকল্পনায় তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর তাঁর চলাফেরার ওপর কঠোর নজরদারি শুরু হয়। এরই মাঝে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সঙ্গে মিলে তিনি গোপনে পিস্তল চালনার প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরে সূর্যসেন কল্পনা ও প্রীতিলতাকে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেন। ক্লাবটি ছিল ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’- এই অবমাননাকর সাইনবোর্ড ঝোলানো এক ঔপনিবেশিক অমানবিকতার প্রতীক। আক্রমণের মাত্র এক সপ্তাহ আগে, বালকের ছদ্মবেশে এলাকা পর্যবেক্ষণে গিয়ে কল্পনা ধরা পড়ে যান পুলিশের হাতে। ফলে, ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব দেন এককভাবে প্রীতিলতা, যিনি আক্রমণ শেষে গুলিবিদ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করেন। জেলের অন্ধকার কক্ষে বসেই কল্পনা শুনেছিলেন তাঁর এই সতীর্থার আত্মোৎসর্গের কথা।
জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর সূর্যসেনের নির্দেশে তিনি আত্মগোপন করেন। কিন্তু বিপ্লবী জীবন সহজ ছিল না। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে পুলিশ তাঁদের গোপন আস্তানা ঘিরে ফেলে। সূর্যসেন ধরা পড়েন। তবে কল্পনা ও সহকর্মী মহেন্দ্র দত্ত তখন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এরপরও বেশিদিন আত্মগোপন সম্ভব হয়নি। ওই বছরের ১৯ মে কল্পনা ধরা পড়েন তাঁর দলের কয়েকজনসহ। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দ্বিতীয় দফা বিচার শুরু হয়, যেখানে সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসি দেওয়া হয়, আর কল্পনাকে দেওয়া হয় ‘ট্রান্সপোর্টেশন ফর লাইফ’- অর্থাৎ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড।
ছয় বছরের দীর্ঘ কারাবাস শেষে তিনি মুক্তি পান ১৯৩৯ সালে, সাধারণ ক্ষমার আওতায়। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি আবার লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন এবং ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। আবারও সক্রিয় হন রাজনীতিতে। তিনি যোগ দেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে এবং চট্টগ্রামে ফিরে গড়ে তোলেন কৃষক ও নারী ফ্রন্ট। ১৯৪৬ সালে তিনি বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন। কিন্তু দেশভাগের পর বদলে যায় রাজনৈতিক বাস্তবতা। তিনি চলে যান ভারতে এবং ধীরে ধীরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও ছিল ইতিহাসের রূপচিত্র। ১৯৪৩ সালে তিনি বিয়ে করেন বিপ্লবী নেতা পিসি জোশিকে। তাঁদের একটি পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। ১৯৪৫ সালে তিনি লেখেন ‘Chittagong Armoury Raiders: Reminiscences’ নামের এক স্মৃতিকথা, যা আজও চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের ইতিহাসে অমূল্য দলিল হিসেবে গণ্য হয়। এই বইয়ে তিনি তুলে ধরেছেন বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ উত্তাপ, ছদ্মবেশ, ষড়যন্ত্র, রক্ত ও বিশ্বাসঘাতকতার নানা অজানা অধ্যায়।
১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে কল্পনা দত্ত পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যু ছিল নিঃশব্দ, কিন্তু তাঁর জীবন যেন বজ্রধ্বনি। আজকের অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে হয়তো তাঁর নামই অপরিচিত। অথচ এই নারী একসময় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, পেছনে ছিল না রাষ্ট্রের কোনো সমর্থন, কাঁধে ছিল শুধু দেশমাতৃকার আহ্বান।
এই কল্পনা কোনো কল্পনা নয়- তিনি ছিলেন বাংলার বাস্তব ইতিহাসের এক সাহসী অধ্যায়। প্রীতিলতা, বিনা দাস, বীণা দাসগুপ্তের মতো তিনিও প্রমাণ করেছিলেন, নারী মানেই কেবল শীতলতা নয়- নারী নিজেই হতে পারেন আগুন। হতে পারেন অস্ত্রধারী, দ্রোহী, এবং স্বাধীনতার এক অমোঘ প্রতীক।
আজ তাঁর জন্মদিনে, এই অগ্নিকন্যার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। তিনি শুধু এক বিপ্লবী নন, তিনি এক প্রেরণার নাম। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন- অন্যায়ের কাছে নত না হয়ে প্রতিবাদ করাই মনুষ্যত্ব, আর আত্মত্যাগের পথেই ইতিহাসের জন্ম।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্টার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: b_golap@yahoo.com
Leave a Reply