November 23, 2025, 3:18 am

News Headline :
ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলা: এখনই জারি হোক জাতীয় সিসমিক সতর্কতা দুই দাবীতে বরিশালে এসডিএফ, এসসিএমএফ প্রকল্পের কর্মীদের স্মারকলিপি টাইফয়েড ভ্যাকসিন নিয়ে বরিশাল জেলা তথ্য অফিসের দিনব্যাপী প্রচারণা বরিশালে শ্রমিকদল নেতাসহ তিন জনের ওপর হামলার অভিযোগ বরিশাল আদালত পরিদর্শনে আসছেন প্রধান বিচারপতি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ আছে, ইলিশ নেই বাঙ্গালীর স্বাদে ব্যবসা নিভু নিভু ॥ ছন্দহীন তবলার কারিগরেরা গ্রাহকের অর্থ নিয়ে কোন ধরনের প্রতারণা করেনি ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট:সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকের এজেন্ট বাউফলে নিখোঁজের দুই দিন পর জেলের মরদেহ উদ্ধার উজিরপুরে ছেলের হাতে বাবা খুন!
ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলা: এখনই জারি হোক জাতীয় সিসমিক সতর্কতা

ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলা: এখনই জারি হোক জাতীয় সিসমিক সতর্কতা

বাহাউদ্দিন গোলাপ 
​নিঃশব্দে, কিন্তু অনিবার্যভাবে—ভূগর্ভের অভ্যন্তরে যুগ যুগ ধরে জমা হওয়া এক মহাজাগতিক চাপ যখন মুক্তি চাইল, তার প্রথম প্রকাশ ঘটল শুক্রবার সকালে। ২১ নভেম্বর শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে যখন দেশের কোটি কোটি মানুষ দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত, ঠিক তখনই মাটি কেঁপে উঠল। ৫ দশমিক ৭ মাত্রার এই কম্পন কেবল দেওয়াল বা জানালা কাঁপায়নি, এটি আমাদের জাতীয় উদাসীনতার কাঠামোটিও কাঁপিয়ে দিয়েছে। এই ঝাঁকুনির তীব্রতা অনুভবের সাথে সাথেই হয়তো কোনো মা আতঙ্কিত হয়ে তার সন্তানের দিকে ছুটে গিয়েছেন, আর কর্মব্যস্ত মানুষটি খুঁজেছেন নিরাপদ আশ্রয়। আজকের এই ভূমিকম্প প্রমাণ করল যে, আমাদের সম্মিলিত ‘চরম উদাসীনতা’ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ঘাটতি নিয়ে আর এক মুহূর্তও কালক্ষেপণ করা চলে না। অবিলম্বে, জাতীয় সিসমিক সতর্কতা জারি এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবী।
​আমরা এমন এক ভূতাত্ত্বিক ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা—এই তিনটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেট একে অপরের সঙ্গে ক্রিয়াশীল। আজকের কম্পনের উৎস নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যে বিশ্লেষণ দিয়েছেন, তা গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। এটি ঘটেছে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে। ভূতাত্ত্বিক মডেলিং অনুযায়ী, এই অঞ্চলে কমপক্ষে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়ে আছে। ভূ-তাত্ত্বিকরা এই ঘটনাকে ‘কো-সিসমিক স্লিপ’ হিসেবে দেখছেন। এই ৫.৭ মাত্রার ইভেন্ট ইঙ্গিত করে যে এতদিন ধরে ‘অ্যাস্পারিটি’ বা প্লেটের আটকে থাকা অংশটিতে যে স্থিতিস্থাপক চাপ তৈরি হয়েছিল, তা আংশিকভাবে মুক্তি পেয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকার মাটির দুর্বল প্রকৃতি। বুয়েট জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার পূর্বাঞ্চলীয় ভরাট এলাকা এবং নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে সয়েল লিকুইফ্যাকশনের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে উচ্চ, যা ভূমিকম্পের তীব্রতা দ্বিগুণ করতে পারে।
দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস (Disaster Risk Reduction বা DRR)
কেবল একটি কারিগরি বা প্রকৌশলগত বিষয় নয়; এটি সুশাসনের মৌলিক নৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং আন্তঃপ্রজন্মগত ন্যায়বিচারের গুরুতর লঙ্ঘন। আমাদের এই প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডিআরআর-এর লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া জরুরি। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মডেলিং অনুযায়ী, যদি ‘বিগ ওয়ান’ আঘাত হানে, তবে এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিয়ে পুঁজি পাচার ত্বরান্বিত করতে পারে। এমনকি, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার পোশাক শিল্প এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে দীর্ঘমেয়াদী স্থবিরতা সৃষ্টি হতে পারে। জাতিসংঘের UNDRR-এর মতে, প্রাথমিক ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবিলায় $১৫ থেকে $২০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন হতে পারে। তাই প্রস্তুতিমূলক বিনিয়োগ হলো মূলত দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার কৌশলগত প্রিমিয়াম, কারণ মানব পুঁজি এবং দক্ষ জনশক্তি রক্ষা করাই একটি দেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি।
​আমাদের দুর্বলতার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। রাজউক ও বুয়েটের যৌথ Rapid Visual Screening (RVS) ডাটা অনুযায়ী, ঢাকাতে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা এখন ৩০ হাজার অতিক্রম করেছে। Bangladesh National Building Code (BNBC) লঙ্ঘন কেবল দুর্নীতি নয়, এটি একটি কাঠামোগত ব্যর্থতা, যা প্রমাণ করে যে জীবন রক্ষাকারী নীতি প্রয়োগে রাষ্ট্রের সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা যথেষ্ট দুর্বল। ১৯৯৩ সালে BNBC প্রণীত হওয়া সত্ত্বেও, কেন ৩০ বছর পর আজও এর প্রয়োগ নিশ্চিত হয়নি, সেই ঐতিহাসিক ব্যর্থতার কারণগুলো জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। BNBC কার্যকর না হওয়ার পেছনে কেবল প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়, বরং একটি শক্তিশালী রিয়েল এস্টেট লবিং-এর প্রভাব কাজ করে। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪-৫ লাখ মানুষ ঢাকা মহানগরীতে আসছে। এই জলবায়ু অভিবাসন সরাসরি ঘনবসতি বৃদ্ধি করে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে চাপ বাড়াচ্ছে।
​এই সিসমিক বাস্তবতায়, জাতীয় সিসমিক সতর্কতা জারির প্রথম ধাপ হিসেবে আমাদের প্রস্তুতিকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে হবে। প্রথমত, কাঠামোগত দুর্বলতা দূরীকরণের কোনো বিকল্প নেই। BNBC প্রয়োগ নিশ্চিত করতে দ্রুত তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন অডিট সংস্থা বা নাগরিক পর্যবেক্ষক কমিটি গঠনের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। রেট্রোফিটিংয়ের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল বা সফট লোন স্কিম চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। যেখানে ক্যালিফোর্নিয়ার মতো উন্নত অর্থনীতিতে রেট্রোফিটিংয়ের খরচ বীমা বা সরকারি বন্ডের মাধ্যমে সুনিশ্চিত করা হয়, সেখানে আমাদের দেশে এ বিষয়ে কোনও কার্যকর আর্থিক মডেল নেই। সরকারের উচিত বিশ্বব্যাংক বা এডিবি’র সহায়তায় একটি জাতীয় সিসমিক ইনস্যুরেন্স পুল (National Seismic Insurance Pool) বা ক্যাটাস্ট্রফি বন্ড (Catastrophe Bond) মার্কেট তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাই করা। দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি কমাতে, দ্রুত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ শুরু করে সেকেন্ডারি সিটিগুলোতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা আবশ্যক।
​দ্বিতীয়ত, কৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। জাতীয় সিসমিক সতর্কতার অংশ হিসেবে, আমাদের উচিত জাপানের JMA বা ক্যালিফোর্নিয়ার ShakeAlert-এর মতো আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম (EWS) স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। প্রশিক্ষিত আরবান সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ (USAR) টিমের সংখ্যা ও লজিস্টিকস আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করা জরুরি। আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়, জীবিতদের উদ্ধারের জন্য প্রথম ৭২ ঘণ্টা ‘গোল্ডেন আওয়ার’ হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে ঢাকার যোগাযোগ অবকাঠামো ও জনঘনত্ব বিবেচনা করলে, আমাদের USAR টিমগুলোর পক্ষে সেই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ব্যাপক ধ্বংসস্তূপের নিচে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। প্রকৌশলীদের সিসমিক ডিজাইন সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক না করা হলে, তা সরাসরি বিশ্বব্যাংকের মতো উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে প্রজেক্ট ফিন্যান্সিংয়ে নেতিবাচক সংকেত দেবে।
জাতীয় সিসমিক সতর্কতা জারি হলে এর কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত প্রস্তুতি জরুরি। এ লক্ষ্যে প্রতিটি স্কুল, কলেজ, অফিস এবং শিল্প কারখানায় বাধ্যতামূলকভাবে মাসিক ভিত্তিতে ভূমিকম্প মহড়া এবং জরুরি নির্গমন পথের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে কেবল দুর্যোগের খবর প্রচার না করে, বরং দুর্যোগ সাক্ষরতা বাড়াতে নিয়মিত এবং বিজ্ঞানসম্মত অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ড বা মহল্লায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করে তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধান ও উদ্ধার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া অপরিহার্য। প্রতিটি পরিবারকে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সহ একটি জরুরি ব্যাগ (Go-Bag) প্রস্তুত রাখতে উৎসাহিত করা উচিত। সরকার এবং বেসরকারি খাতকে সম্মিলিতভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধমূলক কাজের জন্য একটি বিশেষ সরাসরি তহবিল (Direct Fund) গঠন করতে হবে, যা কেবল জরুরি রেট্রোফিটিং এবং প্রস্তুতিমূলক কাজে ব্যবহৃত হবে।
​ভূমিকম্পের বিপদ কোনো সীমান্তের তোয়াক্কা করে না, তাই ঢাকাকে উচিত হবে সার্ক বা বিমসটেক প্ল্যাটফর্মে আঞ্চলিক সিসমিক ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া এবং ভারত, নেপাল ও মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথভাবে মহড়া আয়োজনের উদ্যোগের মাধ্যমে যৌথ প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ বিনিময়ের নেতৃত্ব দেওয়া। এই ৫.৭ মাত্রার কম্পনটি যদি কেবল একটি মহড়া হয়ে থাকে, তবে সরকার কবে চূড়ান্ত মহড়ার প্রস্তুতি নেবে— সেই প্রশ্নটি জাতির কাছে বড় হয়ে দাঁড়াল। জীবন বাঁচানোর এই বিনিয়োগ কেবল অবকাঠামো নয়, এটি আমাদের জাতীয় আত্মবিশ্বাস এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার। আমরা কি ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে বলতে পারব, ‘আমরা জানতাম, কিন্তু কিছু করিনি’? আসলে, প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হলো এক একটি অপেক্ষমাণ গণকবর, যার নির্মাণের দায়ভার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের। এই নীরবতা কি শুধু উদাসীনতা, নাকি রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত এক প্রকার অলিখিত ঝুঁকি? জীবন বাঁচানোর এই বিনিয়োগে কালক্ষেপণ মানেই একটি নিশ্চিত জাতীয় আত্মহত্যা; ভূমিকম্পের আঘাত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হতে পারে, কিন্তু সেই আঘাতের কারণে ব্যাপক প্রাণহানি হবে সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
01712070133

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © All rights reserved © 2024 DailyBiplobiBangladesh.com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com